
সৈয়দা রাশিদা বারী
নিশ্চয়ই এটা আমার মায়ের কোন এক প্রস্ফুটিত রঙিন মাধুর্য্য ভরা দিনের কথা। তার মানে মায়ের ছিলো ইয়াং কাল, আমার শিশুকাল। হ্যাঁ মা আমাকে নিয়ে তার মায়ের বাড়ি হতে, ভাইয়ের বাড়িতে যান। মানে আমার নানি বাড়ি (বিষ্ণুরিয়া) হতে, মামার বাসায় (কুষ্টিয়া শহর) যান। যেহেতু নানাকে আমি দেখি নাই, আমার জন্মের বহু আগেই প্রয়াত/ মৃত্যু হওয়ায়। কাজেই নানার বাড়ি বলা আমার প্রচলন নাই। আর আমি শিশু থেকেই বাস্তববাদী। বাস্তবে বিশ্বাসী ও নগদে আস্থাশীল ছিলাম। কিচ্ছা কথাই বিশ্বাসী, কোন দিনও ছিলাম না। বাকিতে ফাকি, এমনটাই বর্তমানে জানি, দেখি, বুঝি। কিন্তু আমি সেটা ছিলাম অগ্রিম, শিশু কালেই। যে কারণে মৌখিক, সাপ বাঘ ভাল্লুক, ভূত পেত বা জুজু বুড়ির ভয় পর্যন্তও আমি পেতাম না। তাছাড়াও একবার মেধা মননে ধারণ করলে, সেটি ছুঁড়ে ফেলাও শিখি নাই, বলতে পারি। যেটা শুধু এই বড় বেলায়ই নয়, ছোটবেলায়ও ছিলাম। যার নমুন-মানে প্রমান, সেই নেংটা কালের বা শিশু জীবনের এই সরস গল্পটি। যেটা ছিলো বলা যায়, আসলে একটা কাহিনী। আর যার ফলে আমি চিরকাল নানার বাড়িটাকে, নানির বাড়ি বলি। কেননা, নানাকে তো দেখিই নাই, নানা তেমন প্রভাবশালীও বোধ হয় ছিলেন না। তাই তার সম্বন্ধে কোন গল্পও কেউ আমাকে শোনান নাই। যেমন আমার দাদার গল্প শুনতে পেয়েছি। তো নানীর বাড়ি না বলে, তার বাড়ি বলবো কেন? যাইহোক- আমার সিভিল সার্জন মামার বিলাতে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া, আমি দেখি নাই, তবে শুনেছি। তার বিলাত থেকে আনা অন্য ধরনের আনকমন একটা গ্লাস দানি আমার কাছে ছিলো। যেটা না স্টিল, না সিলভার। কাঁসা কিংবা পিতলেরও না। তবে ঢালাই করা কোথাও জোড়া তালি ছিলো না। খুব ভারী নয়, ফিনফিনে পাতলাও নয়। কখনোই জং ধরবে না, এরকম এক জাতীয় মিটারের ঢালাই দিয়ে বানানো, একদম জোড়া তালি ছাড়া। অবশ্যই সেটা আমার জন্য শখের ছিলো। তাই কোনদিনও কাজ করি নাই বটে, শুধু আগলেই রেখেছি। দেখেছি পড়ার টেবিলে রেখে আর শুধু খেলা করেছি। যার ফলে বিয়ে হলেও আমি ওই বাড়িতে, কুষ্টিয়াতে এলে, এই কুষ্টিয়ার বাসাতে, এবং কুষ্টিয়া হতে ঢাকাতেও নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই জিনিসটিকে শিশুকালে কেঁদে কেঁটে, জোর করে অথবা যে কোনভাবে আমি নানীর কাছ থেকে আদায় করেছিলাম। তবে এই একই রকম আরো কয়েকটা নানীর বাড়িতে ছিলো, এই একটাই নিয়ে এসেছিলাম। সেটিকে আনার জন্য আমি আমার মায়ের মুড়ির মধ্যে, চিড়ের মধ্যে, চাউলের মধ্যেও লুকিয়েছি। যার ফলে নানী আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এখন (৫ বছর) আর নাই, সে আলাদা এক বিদারক কাহিনী। এই কাহিনী এখন লিখবো না। নারীরা যেহেতু পরাধীন তাই সব কাহিনীই, সবসময় প্রকাশ করতে পারে না, সৃজনশীল ও বৈধ হলেও। হ্যাঁ সেই ডাক্তার-আব্দুল মান্নান মামা, বিলাত পাস, নাকি বিলাত পড়তে যাওয়া অবস্থার তখন ছিলেন, সে আমার জানা নাই। তবে তিনি বিলাত থেকে পাস করে এসে, হয়েছিলেন সিভিল সার্জন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার আব্দুল মান্নান। বর্তমানে যার নামে এবং যে বাসায় মান্নান হাট সেন্টার বা মান্নান হাট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কুষ্টিয়া থানা পাড়া ৬রাস্তার মোড়। আমি ওই বাসার কথাই বলছি। ওই বাসাতেই মা আমাকে নিয়ে উঠেছিলেন কোন এক ঈদ পালন করা উপলক্ষে। অথবা ঈদের পরে ঈদ পুনর্মিলনীতে। বিলাত পাস, অথবা বিলা পড়ুয়া, ডাক্তার মান্নান মামা, মামী এবং আমার মায়ের শাড়ি এনেছেন, একই রকম। কশি টানা বা ডোরাকাটা, কেবল রঙের পার্থক্য, লাল এবং নীল। আর সেটা সুতিও নয়, সিল্কেরো নয়, অন্যরকম বেনারসি কাপড়।
মামী ফর্সা, মা কালো, বোধ হয় সেই কারণে বা কেন যেন আমার মায়েরটা ছিলো সাদার উপরে লাল আকি আকি, কশি টানা দাগের। ঠিক তেমনি আমার বুবুর, আমার মামাতো বোন লিপির এবং আমার পোশাক গুলোও প্রায় একই ছিলো, শুধু রঙের পার্থক্য। তবে আমি এখানে বলবো আমার বুবুর স্মৃতি নয়, কারণ বুবুর কিছু আর মনে পড়ছে না। মানে অন্য আর কিছু মনে নাই। সাল টালও কিছু মনে নাই। ঈদটা ঈদুল ফিতর না ঈদুল আযহা ছিলো তাও তো মনে নাই। মনে অন্য আর কিছু আসে না। কি খেয়েছি, না খেয়েছি, তাও না। কেবল মনে আছে, মা আমাকে তেল কাগজ দিয়ে কানের উপরে, কপালের ধারে, কাজলের ফোটায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন। কপালের ধারের টিপটা দিতে, আমার মাথা বেঁকে যেতো এবং ব্যাথা লাগত তাই মনে আছে। আর যেটা মনে পড়ে সেটা ভালো জিনিস নয়। ঈদ উপলক্ষের কোন এক স্মৃতি বলতে, অথবা না বালিকা বয়সের শিশুকালের সরস কাহিনীও একসময় গল্প হয়ে দাঁড়ায়, বলতে আমি সেটাই লিখতে চেয়েছি। সেটা কেন যেন মামাতো ওই বোন, লিপির সাথে আমার ঝগড়া হয়। কি নিয়ে ঝগড়া হয়, মানে ঝগড়ার প্রতিপাদ্য বা সূত্রপাত কি ছিলো, সেটাও মনে নাই। তবে মনে দানা বেধে আছে, ও আমাকে বলেছিলো, ‘আমাদের বাড়ি হতে চলে যা’। মায়ের লাল শাড়িটা তখন আলনাতে ছিলো। লাল নীল দুটি শাড়ি পাশাপাশি ভাঁজ করা। চলে যা বলছে, আর বলার সাথে, লাল শাড়িটা বারবার আলনা হতে নিচে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। আর আমি আমার রবারের প্যান্টি ঢিল হয়ে যাওয়ায়, না কেন যেন নিচে নেমে যাওয়াই, সেটি খুলে রেখেই বারবার উঠাচ্ছিলাম। কিন্তু ওর সাথে আমি পারছিলাম না! যদিও ও আমার থেকে দুই এক মাসের ছোট হবে। তখন ব্যাপারটা উপলব্ধি না করতে পারলেও, পরে জানি, যে ও ছোট, সেটা মা, মামানিই বলেছেন। তার আবার একটা কাহিনীও আছে। সেটাও উদঘাটন করেছি। আমরা দুজন মায়ের পেটে থাকতেই বদল হয়েছিলাম। যদি আমি মেয়ে হই, আর ও ছেলে হয়, তবে বদল বাস্তবায়ন হবে। কেননা আমার বড় বোন ছিল একজন। আমার সেই বোন আমার থেকে ৬বছরের বড়। আর ওর ছিলো তিনটা বড় ভাই। কাজেই আমার মায়ের প্রয়োজন ছেলের, ওর মায়ের প্রয়োজন মেয়ের। এখনকার মতো তখন তো আর অগ্রিম ভবিষ্যৎ বোঝা যেত না। পেটের মধ্যে ছেলে, না মেয়ে, কি আছে? তখন ভূমিষ্ঠর পরেই জানা যেত। তাই ওই পর্যন্ত ওয়েট করতে আমরা দুজনেই আল্লাহর মেহেরবানীতে আমাদের মায়ের কন্যা হয়েছিলাম। তবে জন্মের পরে ওর সোনার চামচ মুখে উঠলেও আমার জীবনের উপরে এক ফারাও আবিষ্কার হয়। এই কাহিনী সে আর এক কাহিনী। কাহিনী থেকে বাচ্চা গুজিয়ে আরো কাহিনী হয়েছে। হৃদয় বিদারক কাহিনীও হয়েছে।
যাক সেই কাহিনীতে আর আজ যাব না। আজ মায়ের এই সুখ ভ্রমণ, ঈদ পালন অথবা ঈদ পুনর্মিলনী যেটাই হোক ছিলো, সেই টুকুই বলবো। আমি ওর আলনা হতে, আমার মায়ের শাড়িটা ছুড়ে ফেলানো, উঠাতে উঠাতে হাঁপিয়ে পড়লাম। এরপর যখন ও বললো, তুই আমার দাদির বাড়িতেও যাবি না তখনই হেরে গেলাম। এমন হারলাম যে, প্যান্টটা পুনরায় পড়ার উপায়ান্তর পেলাম না। নেংটা হয়েই উঠাচ্ছিলাম পুরাটা সময় জুড়ে যদিও। এক পা প্যান্ট এর মধ্যে ঢোকালেও, অপর পা না ঢুকাতেই, ও আবার আমার মায়ের শাড়িটা ছুড়ে ফেলছিলো। আর আমি পা বের করে নিয়ে আবার তুলছিলাম। বুদ্ধি থাকলে তো মা এবং মামীকে ডেকে এনেই দেখাতাম। সে বুদ্ধিও ছিলোনা। এভাবে আর না পেরে হেরে গেলাম। না পারলাম প্যান্ট করতে, না পারলাম মায়ের শাড়ি আলনাই রাখতে। হারলাম ওর খোঁটা দেওয়ার কাছেও। ওর দাদার বাড়ি আমরা থাকি, আমার দাদার বাড়ি তো ওরা থাকেনা! আমার মনে আছে, আমি ওর মায়ের শাড়িটা একবারও আলনা থেকে নামিয়ে দেইনি বা ছুঁড়ে ফেলে প্রতিশোধ নিই নাই। যেহেতু একই রকমের শাড়ি দুইটা, পাশাপাশি ছিলো। তাই আমিও বিপরীতে ছুড়ে দিতে পারতাম, কিন্তু সেটা করি নাই। বরং ও আমার মায়ের শাড়ী ছুঁড়ে ফেললে, আমি উঠিয়ে সেখানেই পাশাপাশি রাখছিলাম আর কাঁদছিলাম। এখন ওই কারণটা বুঝতে পারি, সেটা ছিল আমার বাবার বেকারত্ব। আর আমার মায়ের অসহায়ত্ব। তাই আমি ওই বাড়ি হতে চলে আসার জন্য ন্যাংটা হয়েই কেঁদে কেঁদে, পরবর্তীতে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে হাজার টানলেও, মা আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যান নাই। আমার বাবার বাড়িও চলে আসেন নাই। এবং কোন প্রতিবাদও করেন নাই। আমার জীবনের প্রথম পরাজয়ই এটা ছিলো। হ্যাঁ এটাই ছিলো বলে আমি মনে করি। শুধু সময় এবং বয়সেরই হিসেব আমার জানা নাই। তাহলে আমার বাবা তখন কোথায় ছিলেন? শুনেছি আমার বাবা অল্প বয়সেই, ৫২ সালের আগেও একাধিকবার এই দেশ ও দশের স্বার্থের জন্য ব্রিটিশ শোষক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেলে যান। এখান থেকেও তার পড়াশোনায় ইয়ার লচ হয়েছে বটে কিন্তু ক্ষতি হয়নি। যেহেতু বাবার মা, আমার দাদি তখন বেঁচে ছিলেন। তাই বাবার সমস্যা হয় নাই পড়াশোনা চালিয়ে নেবার। বাবা মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার আগেও জেলে গিয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। আবার পরীক্ষা দেবার পরেও রেজাল্টের আগে জেলে গিয়েছিলেন। যে কারণে আমার একসময়ের প্রেসিডেন্ট থাকা এবং পরবর্তীকালে একাধিকবার চেয়ারম্যান হওয়া জনপ্রতিনিধ চাচা বলেছিলেন, ও (পুনু) যদি পাশ করে, তো আমার হাতের তালুতে দুর্বালতা, দূর্বাঘাস গজাবে। পরে যখন ফ্যামিলির মানুষজন রেজাল্ট জানলো, ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেছেন বাবা। তখন আমার চাচি স্বামীকে, মানে আমার চেয়ারম্যান চাচাকে বলেছিলেন, আপনার কথার কি হবে? হাতের তালুতে দুর্বা ঘাস দেখান? আপনার ছোট ভাই পুনু মিয়া তো অনেক নাম্বার পেয়ে, ভালোভাবে পাশ করেছে। সে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছে। চাচা বলেছিলেন আশ্চর্য হয়ে, ওর তো শুধু ওটাতেই জুত আছে।
সেই বাবাকে ৫২ সালের পূর্বে, আমার সেজ চাচা, যিনি ছিলেন সরকারের পিপি, পরবর্তীতে ইনকাম ট্যাক্স এর উকিল (আইনজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ) আমার বাবাকে বারবার ছাড়িয়ে এনেছেন, তার মায়ের চোখের পানি মোছাতে। কিন্তু তার মা মারা যাবার পরে, মায়ের অবর্তমানে, চাচার চাকরিতে ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকাই, রাগ অনুরাগ অভিমান করে, প্রিয় ছোট ভাইকে আর জেল থেকে ছাড়িয়ে আনলেন না। জেলে থেকে যে পরীক্ষা দেবে, সেই সহযোগিতাও করলেন না নিজে এবং অন্য আর কারো সহযোগিতা না করতে, নির্দেশ দিলেন! এতে মেধাবী ছাত্র হয়েও বাবার পরীক্ষা দেওয়া হলো না!! অথচ সাধারণ ছাত্র ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম জেলে বসেই পরীক্ষা দিতে পারলেন। কারণ তার আত্মীয়স্বজন হেল্প করেছিলেন। আর আমার বাবা সরকারের বিরুদ্ধের সেরা আন্দোলক হিসেবে, বেশি দাগি হওয়ায়, আমার বাবার উপর সরকারের মানুষদের তো রাগ থাকবেই, তাই শাস্তিও বেশিই দিচ্ছিলো একজন অত্যন্ত ভালো, ব্রিলিয়ান্ট মেধাবী ছাত্রকে। যে কিনা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল হতে ১৯৪৮ সালে সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশনে মেট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন। যদিও তখন ট্যালেন্ট পুল দেওয়া হতো না। আর মুসলমানদের ফেল করিয়ে দেওয়া হতো। সেই সব কিছুই ইংরেজির যুগে। শুনেছি সেইবারই বাবা, সবচেয়ে বেশিদিন জেলে থাকলেন। এরপর ছারা পেলে বাবাকে বাসা হতেই নামিয়ে দিয়েছিলেন, এক কাপড়ে। পড়ালেখা খাওয়া এবং চলাফেরার, খরচপত্র দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হয়ে, দেশ ও দশের স্বার্থে বারবার জেলে যাওয়ায় এবং এই ভাষা আন্দোলনে ধরা পড়ে, জেলে যাওয়াতে প্রায় প্রতিটা আত্মীয়-স্বজন ক্ষুব্ধ হন বাবার উপর। শুনেছি জেলে যাওয়ার কারণে আমার ক্ষুধার্ত বাবার ভাতের প্লেট পর্যন্ত সম্মুখ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন! মারধর করা ছাড়াও!!
পূর্বেই আমার শিক্ষাবিদ শিল্পপতি ১৪টি ভাষায় কথা বলা, ল্যাটিন ভাষার উপর স্পেশালিস্ট সুদক্ষ প-িত দাদা, যিনি ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর, শিক্ষা ইন্সপেক্টর থেকে বিশ্বের বেশ কিছু কলেজ ইউনিভার্সিটির খন্ডকালীন লেকচারার। আর সেসবের ব্রিটিশ সরকারই তাকে জোর করে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দাদা ছিলেন তার বাবার একমাত্র পুত্র। যার ছিলো তুমুল শিক্ষার নেশা। এই নেশায় তাকে মনঃপুত এবং প্রয়োজন মতো বাড়িতে দাঁড়াতে দেয়নি। দাদার বাবা দাদাকে ডেকে বলেছিলেন, তুমি যতই শিক্ষা অর্জন করো, শিক্ষা শেষ করে, আমার শিল্প প্রতিষ্ঠানের হাল তোমারি ধরতে হবে। তুমিই ধরবে, সেটা আমার কথা দাও। পরের অধীনে চাকরি তুমি করবে না। দাদা দাদার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন। চাকরি করবেন না, শিল্প প্রতিষ্ঠানই ধরবেন, এটা দাদা, দাদার বাবাকে কথা দিয়েছেন। এই কথা দাদা ব্রিটিশ সরকারকে জানালে, তবুও অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার চাপ দিয়েছে, জবাব দিহিতায়। কেন সে এতো শিক্ষা অর্জন করলেন? এই জবাবদিহিতা চেয়ে বাধ্যতা মূলক চাকরি দেয়। চাকরি করতেই হবে ব্রিটিশ শাসক শোষক সরকার নির্দেশ দিয়ে দেয়। একদিকে শিল্প প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে চাকুরী। আবার দাদা তো এখনকার মানুষের মতো ফাঁকিবাজও ছিলেন না বলতে, আমাদের বংশ ফাকি দিতে জানেও না। এটাতে দাদার বেশি হয়ে যায় পরিশ্রম। দাদার একমাত্র আদরের কন্যার বিয়ে হলো, সরকার কর্তৃক উপাধি প্রাপ্ত খান বাহাদুরের সাথে। শিক্ষা দীক্ষা সব কিছুতে তারাও ঐতিহ্যবাহী এবং প্রভাবশালী। মহানবী সাঃ তথা আলির বংশধর। দাদা এক মাসের ছুটি নেন সব দায়িত্ব থেকে। ওই জামাতাকে বাড়িতে আনার জন্য উদ্যোগ নেন, নতুন করে আরো মডার্ন বাড়ি নির্মাণের ও বাড়ি সাজানোর। প্রথমেই বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী লেখা জঙ্গল কাটালেন, তার এক দাগের ২৩বিঘার সীমানা থেকে। এক সপ্তাহে ২০জন লেবার সেই কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলো। জঙ্গল কাটাবার ম্যানেজারও ছিলেন, বাড়ির ম্যানেজার করিম দাদা। দ্বিতীয় সপ্তাহে বাড়ির কাজের ডিরেকশন দিতেই দাদা ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। আমার আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী বাচ্চু চাচা লিখেছেন যে, ‘তখনো বাবার হাতে মোটা একটি বই ছিলো।'( মানে শিক্ষাবিদ শিল্পপতি দাদার হাতে,) যা তার হাত হতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো আর সে বারবার মাটি হতে তুলে বগলের মধ্যে রাখছিলেন। শেষ আর রাখতে পারলেন না, মানে মাটি হতে গ্রন্থ উঠাতে পারলেন না। বাবা নিজেই মাটিতে পড়ে গেলেন এবং আর উঠতে পারলেন না। ইতিমধ্যে তার কর্মচারী ও লেবাররা ধরাশায়ী করে বাড়ির মধ্যে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন।’ হ্যাঁ দাদা আর উঠতে পারেন নাই এবং তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বাকরুদ্ধ অবস্থায় খুবই কঠিন অসুস্থতায় বিছানায় কিছুদিন থেকে, মারা যান। সেটা ১৯৩৭ ইং সাল। তাই দাদা তার বিশাল সীমানার জঙ্গল কাটালেও বাড়ি বানাতে পারলেন না প্ল্যান মতো। হ্যাঁ মর্ডান বাড়ি বানাতে তিনি পারলেন না বটে। বাড়ি বানাতে পারলেন না, তার মানে বাড়ি হীন রইলেন তা নয়। ৮চালা টিনের বহু ঐতিহ্যবাহী ঘরের বাড়ি তার পূর্ব থেকেই ছিলো। যদিও বহু পর্দানশীল দাদিকে দেখবার পলিটিক্সে একবার তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো তবুও। তবুও অনেকগুলো সেই বড় বড় ৮চালা টিনের ঘর, বারান্দা, কাচারি, লাইব্রেরী, যার বৈচিত্রতা বহন করেছে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে কিছু, কিছু শরৎ চন্দ্রের দেবদাস গ্রন্থে। কিন্তু তিনি নতুন করে বাড়ি বানানোর ও সাজানোর জন্য বিলাত থেকে যা কিছু আমদানি করেছিলেন, তার সবই এবার অসহায়ের মতো পড়ে রইলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সে সব কিছু কিছু আমিও দেখেছি। আমার দাদার বিশাল এরিয়া জোড়া, আম কাঠাল লিচুর বাগানের মাঝে, স্তুপ আকারে যেনতেন অবস্থায় ছিলো। যার যা ইচ্ছা এবং প্রয়োজন হতো নিয়ে যেতো তবু বহু ছিলো দেখেছি। আর সে সব যেন ফ্রি গোডাউন ছিলো।
আমার বাবার জন্ম ১৯২৬ সালে। দাদা প্রয়াত হলেন ১৯৩৭ সালে। আমার অত্যাধিক ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষাবিদ বড় চাচা, উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র ছিলেন যার গৃহ শিক্ষক। এই বড় চাচা প্রাকৃতিক দুর্যোগে (বাজ / ঠাটা / ডাক) পড়ে কিছুদিন অথম্ভ অবস্থায় থেকে মারা গেলেন ১৯ ৪৬ সালে। যার অত্যাধিক ভালো রেজাল্টের ফলাফলের অভিনন্দন জানাতে কলকাতা ইউনিভার্সিটির কয়েক জন শিক্ষক বাড়ির উপর এসেছিলেন! কিন্তু এই দুঃখের খবর পেয়ে এবং দেখে শুনে তিনারা মর্মাহত হয়ে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনাটি ঘটে রাজবাড়ী চাচার নানি বাড়িতে। মানে আমার দাদির বাবা-মায়ের বাড়িতে। চাচার খালার (বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিনিয়র খবর পাঠক সালেহ আকরাম এর মায়ের বিয়েতে) বিয়ে অনুষ্ঠানে। আর দাদী তার প্রথম সন্তানের অকাল প্রয়াণ সইতে না পেরে মারা গেলেন, মাত্র সন্তানের মৃত্যুর দুই বছরের মধ্যে ১৯৪৮ সালে। যেদিন আমার বাবার মেট্রিকুলেশন এর রেজাল্ট বের হয়। এসব হৃদয় বিদারক কাহিনীর অনেক পরে, ভাষা আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হয়। ভাষা আন্দোলনের ৪বছর পর আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়। ১৯৫৭ সালে আমার বড় বোনের জন্ম। যে ছিলেন আমার ৬ বছরের বড়। আমার জন্ম হয় ১৯৬৩ সালের ২৮শে ডিসেম্বর। শুনেছি সে দিন রবিবার ছিলো। আমার ৪বছর পর আমার ইমিডিয়েট ভাইয়ের জন্ম হয়েছিলো, নানির বাড়িতে। যে আমার বাবা-মায়ের প্রথম পুত্র। আমাদের ৯ভাই বোনের মধ্যে, মানে আমার বাবা মায়ের ৯ সন্তানের মধ্যে, একমাত্র আমার এই ভাইটির জন্মই বিষ্ণু দেয়ার নানি বাড়িতে হয়। কিন্তু আমার ওর কথা কিছুই মনে আসছে না। তাই সময়টা কি, মানে ওই ঘটনাটা কি আমার এই ভাইয়ের জন্মের পূর্বেই হবে? না পরে হবে? আমি কিছুই ঠাওর করতে পারছি না, সময়টা আসলে কখন হবে? যখন আমার বাবা এতই বেকার ছিলেন, যে মা আমার অপমানের এবং তার অপমানের প্রতিবাদ টাও করতে পারেন নাই! যেটা আমার এখনো কুরে কুরে খায় এবং আমাকে- বাবা মায়ের ঘরে পুত্র কন্যাকে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শেখায়। এবং সেটাই জরুরি বলে মানসিক প্রেসার সৃষ্টি করে। আমার ছোট্ট জীবনের ওই প্রতিক্রিয়া এখনো প্রভাব ফেলে আমাকে প্রতিবাদীর মুখোমুখি দাঁড় করায়। লেখায়। কাদাঅবশ্যই আমার জীবনের দ্বিতীয় পরাজয়ও আছে। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, পরাজয় পর্যন্ত আমি লিখেছি। ১ম পরাজয় বাদ ছিলো- যেটা আজ লেখলাম।
মা আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যান নাই। আমার বাবার বাড়িও চলে আসেন নাই। এবং কোনো প্রতিবাদও করেন নাই। আমার জীবনের প্রথম পরাজয় এটা ছিলো বলে আমি অন্তর প্রানে ধারণ করি। আরো রক্ত প্রবাহের মতো মনে বাসা বেঁধে আছে একটি প্রশ্ন। সেটা ঐ সময় আমার বাবা কোথায় ছিলেন? বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালী লেখা-অত্তবড় খানদানি জমিদারি বাড়ি, বাগান বাড়ি, বিস্তৃত জঙ্গল, বিঘার পর বিঘা, মাঠ জোলা, খড় বাগান, সদের বাড়ি, দাড়োগার ভিটা, দিঘির পাড়ার রেল লাইনের নিচ দিয়ে মাঠের পর মাঠ-খাল বিল, জোলার ধারের বেতঝাড়, বাঁশঝাড়, গাবঝাড়। বিশাল বিশাল ভূত থাকা কড়ই গাছ। সাল সেগুন লম্বু গাছ। কালো পুকুর ধলো পুকুর। সেই আটচালা টিনের ঘর বাড়ি ফেলে, বাগান পুকুর ফেলে, যে বাড়িতে তার কথা বলার শক্তি নাই, মাথা তোলার সাহস নাই, প্রতিবাদ করার ভাসা নাই, সেখানে সে অন্ধ কালা বোবা হয়ে, আমাকে নিয়ে, কেনো ছিলেন?! যা আমার লেখায় কাদায় ভাষায় ভাবায়! তখন বাবা কোথায় ছিলেন!! এই প্রশ্ন এখন আমার মাকেই করা প্রয়োজন। কিন্তু করোনা মহামারী সন্ত্রাসের জন্য সেটাও হবে না। আগেই যদি জানতাম, বেগানা বেরহম পাষান নিষ্ঠুর করোনা ইবলিস, আমার পৃথিবীকে আমার থেকে সরিয়ে নেবে, এমন একটা অসময়ে, বিনা দোষে, বিনা কারণে, গ্রাস করবে চিরতরে। তবে এই পাষান ঘাতক আমার মাকে আক্রমণ করার আগেই – মায়ের থেকে অনেক কিছু আমার জানার ছিলো, সবই আমি জেনে রাখতাম। যা সময়ের জন্যই বলবো, আমার জানা হয়ে ওঠে নাই। এই যে ঈদ একজন আসেন, নবাব, সাহজাদা। সেও সময়ের হিসেব না নিয়ে। মায়ের ঈদ পালন দেখেছি, কাছ থেকে- দূরে থেকে, মিসেল হৃদিক অনুভবে, অনুবাগে অনুরাগে মিলেমিশে, দেখেছি আরে নানাভাবে। মনে মনে আকুল আনন্দে, কষ্টে এবং দুঃখে, ধরেই নিয়েছি সেটাই আমার ঈদ পালন। কঠিন কোমল আনন্দ বেদনার ঈদ পালন। দারুন মজার ভালো লাগার এবং খারাপ লাগার, ভালোবাসার, না বাসার, ঈদ পালন। আহ আমার সাহিত্য সাংস্কৃতিক ঈদ পালন। তবে এখন যেন মনে হয়, সেই থেকে আজ অবধি, আমার সাংস্কৃতিক সাহিত্য জীবনের প্রতিটা ক্ষণ এবং সবই, ভেলায় ভাষা- হেলায় দোলা- আশার নামে, রং তামাশার ঈদ পালন। সেই থেকে আমার সরস জীবনের, সবই যেন হয়ে গেছে, জন্ম মৃত্যুসম সচ্ছল নির্ভেজাল এক সরস গল্প।